শাহাদৎ হোসেন:
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হায়দরাবাদ একসময় ছিল মুসলিম শাসিত একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র। এটি আয়তনে বর্তমান বাংলাদেশের চেয়েও বড় (৮২,৬৯৮ বর্গমাইল) এবং খনিজ সম্পদ, কৃষি, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল। হায়দরাবাদ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের শুরু হয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে, এবং এই সময় থেকেই এটি মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম হায়দরাবাদ রাষ্ট্রটি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ব্রিটিশ শাসনের সময়েও এটি দেশীয় রাজ্যের মর্যাদা ধরে রেখেছিল। রাজ্যের শাসক ছিলেন নিজাম এবং তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে নিজস্ব প্রশাসন, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। দেশভাগের সময় ভারত কিংবা পাকিস্তান কারো সাথেই যুক্ত হতে নারাজ ছিল হায়দরাবাদ। তবে ভারতের কড়া দৃষ্টি ছিল হায়দরাবাদের ওপর। দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নে দেশটির জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি, সর্বত্র নিজেদের এজেন্ট নিয়োগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিসহ বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশটির সরকার। পরে ভারত সামরিক অভিযান চালালে দেশটি তার স্বাধীনতা হারায় এবং ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়। এই ঘটনা শুধু হায়দরাবাদের স্বাধীনতার সমাপ্তিই নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক চরম নৃশংসতার উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় কলহ সমাজে শান্তি ও সহাবস্থানের পথকে কীভাবে ধ্বংস করতে পারে।

হায়দরাবাদে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে। তখন থেকেই হায়দরাবাদকে কেন্দ্র করে মুসলিম শিল্প-সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটে তা পুরো দাক্ষিণাত্যকে প্রভাবিত করেছিল। ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও হায়দরাবাদ পুরোপুরি স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়নি। ব্রিটিশ সরকারের সাথে চুক্তি সাপেক্ষে এটি একটি দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়। ভারতের বুকে মুসলিম স্বাধীন দেশ হায়দরাবাদের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটে ১৯৪৮ সালে। পরবর্তীতে হায়দরাবাদকে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ৮২,৬৯৮ বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত এবং বাংলাদেশের তুলনায়ও আয়তনে বড় ছিল বিলুপ্ত হায়াদরাবাদ নামক দেশটি।

শুধু আয়তনে নয়, সম্পদ, সমৃদ্ধি এবং সামর্থ্যরে দিক থেকেও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঠিক থাকার সকল যোগ্যতাই হায়দরাবাদের ছিল। হায়দরাবাদের খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, সোনা, লোহা, হীরক প্রভৃতির আকর ছিল। কৃষি সম্পদের মধ্যে চাল, গম, জওয়ার, বজরা, তিল, তিসি ভুট্টা, তামাকের প্রচুর ফলন ছিল। দেশটিতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। নিজস্ব আইন আদালত ছিল। বিচার ব্যবস্থা ছিল। নিজস্ব মুদ্রা ছিল, সেনাবাহিনী ছিল, হাইকোর্ট ছিল, ছিল শুল্ক বিভাগ। নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ছিল ভাষা, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত। দেশে দেশে রাষ্ট্রদূত ছিল, এমনকি জাতিসংঘে নিজস্ব প্রতিনিধিও ছিল।

ইতিহাসবিদ ফাহমিদ-উর-রহমান লিখেছেন, ঊনিশ আর বিশ শতককে বলা যায় মুসলমানদের জন্য এক ক্ষয়িষ্ণুতার যুগ। একালে এসে মুসলমানরা যা পেয়েছে তার চেয়ে হারিয়েছে অনেক বেশী। সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত থাবা একালে মুসলমানদের যত বেশী রক্ত ঝরিয়েছে বোধহয় এর নজির ইতিহাসে খুব একটা পাওয়া যাবে না। দেখতে দেখতে মুসলমান দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদের করতলগত হয়েছে। শত শত বছরের মুসলিম ঐক্যের প্রতীক খেলাফত খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে আর সেই সাথে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন আর নিবর্তনের দীর্ঘ ট্রাজেডী রচিত হয়েছে।

এরকম এক ট্রাজেডীর নাম হচ্ছে হায়দারাবাদ। সাম্রাজ্যবাদের প্রধান পুরোহিত বৃটেন শুধু মুসলিম দুনিয়ায় তার খবরদারি আর রক্তক্ষয় করেই ক্ষান্ত হয়নি। উপনিবেশগুলো থেকে বিদায় নেবার সময় তারা এমন সব সমস্যা জিইয়ে রেখে গেছে, যার মাশুল আজও মুসলমানদের গুণতে হচ্ছে। এর একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে আজকের কাশ্মীর। কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ অদ্যাবধি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী জেহাদ জারি রেখেছে আর হায়দারাবাদের আজাদীপাগল মানুষের সংগ্রামকে অত্যাচার ও নিবর্তনের স্টীমরোলারের তলায় স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন হায়দারাবাদের নাম পৃথিবী মনে রাখেনি।

হায়দরাবাদ নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, তার ছিল স্বাধীন প্রশাসন, প্রতিরক্ষাও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা-এসব আজ বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসের গর্ভে আশ্রয় পেয়েছে। স্বাধীন হায়দারাবাদের শেষ প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলীর লেখা গ্রন্থে হায়দারাবাদের আজাদীপাগল মানুষের সেই বেদনাঘন কাহিনীর বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে হায়দারাবাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে এই লায়েক আলী তার দেশের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ অবধি লড়াই চালিয়েছিলেন। এই লড়াই যখন চলছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী স্বাধীন হায়দারাবাদের ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন বিশ্ব শান্তির মন্ত্র উচ্চারণকারী পুরোহিত দেশগুলো এ অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেনি। এমনকি জাতিসংঘও না।

ভারত স্বাধীনতা অর্জন করার পর, দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা ৫৬টি রাজ্য এবং প্রায় ৫০০টি দেশীয় রাজ্য সমগ্র ভারতের অঙ্গ হিসেবে একত্রিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে এসব রাজ্যের মধ্যে একটি ছিল হায়দরাবাদ, যা বৃহত্তর ভারত থেকে আলাদা অবস্থানে ছিল। হায়দরাবাদ স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল এবং তার শাসক ছিলেন নিজাম। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর, হায়দরাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এক বিশাল রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ সৃষ্টি হয়।

হায়দরাবাদে এ সময় চলছিল এক কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যেখানে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হায়দরাবাদেও প্রবাহিত হচ্ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে যখন কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটি ভারতীয় প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, তখন হায়দরাবাদে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল।

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পর হায়দরাবাদ ছিল একটি মুসলিম শাসিত রাজ্য, যেখানে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তবে, হিন্দু জনগণের মধ্যেও বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সক্রিয় হয়ে ওঠে। হায়দরাবাদের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর হিন্দু সম্প্রদায়ের চাপ বাড়াতে শুরু করে। এদিকে, ভারতের স্বাধীনতার পর কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার কিছু নেতা হায়দরাবাদে অবস্থানরত মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করে।

হায়দরাবাদ দখলের জন্য ভারতের হিন্দু সংগঠনগুলো একটি সুপরিকল্পিত আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। তারা মূলত ভারতের সংগঠনের শাখা হিসেবে কাজ করছিল এবং তাদের কর্মসূচি ভারতের দিক থেকে নির্দেশনা পেত। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ রাজ প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসন আইন চালু করলে, হায়দরাবাদে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও আর্য সমাজীগণ একত্রিত হয়। তারা ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু হায়দরাবাদে এর জন্য পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ইস্যু বা প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতা কে. এম. মুন্সী বোম্বাই প্রদেশ থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে হায়দরাবাদে পাঠান। তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আইন অমান্য করে গ্রেফতার হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কংগ্রেস নেতারা এই আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে প্রচার করেন, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিভেদ তৈরি করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, স্বাধীনতার সংকল্পে রামানন্দ তীর্থের নেতৃত্বে হায়দরাবাদে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। এসময় বিদ্রোহীরা হায়দরাবাদের পুলিশ ফাঁড়ি, রেললাইন, কাস্টমস ঘাঁটি ধ্বংস করে এবং মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায়। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হায়দরাবাদে মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীরা লুটপাট, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং সীমান্তরক্ষীদের সাথে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র ২৯ নভেম্বর ১৯৪৮ তারিখের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বিদ্রোহীরা হায়দরাবাদের ১৭৫টি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর আক্রমণ করেছে, ১২০টি স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে এবং ৬১৫টি কাষ্টমস ও পুলিশ ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। এই আন্দোলনকে হিন্দু ধর্মে পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযানে রুপ দেওয়া হয়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনা বাড়তে থাকে। হায়দরাবাদে শতাধিক মুসলিম নারী ও পুরুষ হত্যা করা হয়। এই সময়ের ঘটনার এক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলে, তাতে এক ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে ওঠে-নিরীহ মুসলিম জনগণের ওপর নৃশংস আক্রমণ চলছিল।

পরিস্থিতি এমনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল যে বিদ্রোহীরা পুলিশ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব ছিল না, কারণ তাদের হাতে ছিল ভারী যুদ্ধাস্ত্র যা ভারত থেকে সরবরাহ করা হচ্ছিল। তারা একের পর এক গ্রাম দখল করে সেখান থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে লাগলো, খাজনা আদায় করতে লাগলো। এরকম এক নাজুক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করলেন। সেখানেও দেখা গেল পুলিশের মতই অস্ত্র সংকট রয়েছে। কারণ বিদ্রোহীদের হাতে ছিল অনেক উন্নত যুদ্ধাস্ত্র। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম সংগঠনগুলোর বসে থাকার উপায় ছিল না। তারা আক্রান্ত মুসলিম জনগণকে সংগঠিত করে, আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র ট্রেনিং দিয়ে তাদের প্রতিরোধ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুললেন।

বিখ্যাত কাসিম রিজভী কলেজ ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তুললেন এক প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, যাদের নাম রাখা হলো ‘রেজাকার’ অর্থ্যাৎ স্বেচ্ছাসেবক। দেখতে দেখতে ঝড়ের দ্রুততায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য জনগণ এগিয়ে আসতে লাগলো। সীমান্ত এলাকায় তারা প্রতিরোধ বুহ্য রচনা করে ভারতীয় অনুপ্রবেশ স্তব্ধ করে দিতেও সক্ষম হলো। পৃথিবীব্যাপী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম ছড়িয়ে পড়লো সেই সাথে কাসিম রিজভীরও সুনাম। কিন্তু মিথ্যা কথা এবং প্রোপাগান্ডায় দক্ষ ভারত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নামে খুন, লুট আর কল্পিত অত্যাচারের গল্প তৈরি করে, রং ছড়িয়ে তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রচার করে, দেশময় আতঙ্ক ছড়াতে লাগলেন। তারা প্রচার করতে লাগলো ভারত হায়দরাবাদ আক্রমণ করলে, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিন্দুদের কচু কাটা করবে। তাদের প্রচারে আতঙ্কিত হয়ে হিন্দুরা দলে দলে ভারতে পালিয়ে যেতে লাগল। সেই সুযোগে ভারত তার স্বরে চিৎকার করতে লাগলো যে, হায়দারাবাদে হিন্দুদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। এভাবেই সংগঠিত অপপ্রচারের মাধ্যমে হায়দারাবাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তারা ভারতে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে লাগল।

তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের জওহরলাল নেহেরু। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল স্বাধীন হায়দরাবাদ রাজ্যকে ভারতের সাথে যুক্ত করতে হায়দরাবাদে সেনাবাহিনীকে প্রবেশের নির্দেশ দেন। ভারতীয় সেনাদের সেই অভিযান ব্যাপক বিপর্যয় বয়ে এনেছিল স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য। বিশেষ করে মারাথওয়ারা অঞ্চলের পরিস্থিতি হয়ে পড়েছিল ভয়াবহ। এদিন তেলেঙ্গগনায় কম্যুনিস্ট বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে অপারেশন পোলোর নামে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দ্রাবাদে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ শুরুর আগেই সেনাপ্রধান আল ইদরুসকে কিনে নেয় ভারত। আল ইদরুস দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অরক্ষিত রাখে, সেনাবাহিনীকে করে রাখে অপ্রস্তুত। ভারত আল ইদরুসের সহায়তায় হায়দ্রাবাদে তার বিপুল সেনাশক্তি, পদাতিক বাহিনী ও বিমান বাহিনীসহকারে শুরু করে সামরিকভাবে আক্রমণ। প্রথমে ট্যাংক বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। এরপর বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে বিভিন্ন বিমানবন্দর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ভারতীয় বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে আর্য সমাজ ও অন্যান্য হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন হায়দ্রাবাদে প্রায় দুই লাখ মুসলিমদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুসলিম নিরীহ নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশুদের হত্যা করেছে, বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে শহর বন্দর গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাহিনী রাজধানী দখল করে। হায়দরাবাদকে অন্ধ্র, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র এই তিন রাজ্যে বিভক্ত করা হয়।

হায়দরাবাদকে ভারতের অংশ করতে যখন সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে পৌঁছেছিল, তখন ভারতীয় বাহিনী সরাসরি হায়দরাবাদে এই অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনী কেবল হায়দরাবাদে প্রবেশ করেই সেখানে গণহত্যা চালায়নি, বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকেও ধ্বংস করে। এই আক্রমণের ফলে অনেক মুসলিম নাগরিক এবং তাদের পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়।

দিনটি ছিল ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮। এই দিনে ভারতের শেষ স্বাধীন মুসলিম সালতানাত বা রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অবসান ঘটে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতে হায়দরাবাদের স্বাধীনতার পক্ষের যোদ্ধাদের পরাজয় ঘটে সেদিন। দাক্ষিণাত্য নামে পরিচিত এই মুসলিম রাষ্ট্রের শেষ সুলতান ওসমান আলী খান নিজাম-উল-মুলক আসেফ জাহ (নবম) ভারতীয় হামলা শুরুর পর ছয় দিন প্রতিরোধ চালিয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপক রক্তপাত এড়াতে তার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ফলে প্রায় ৬০০ বছরের স্বাধীন এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অবসান ঘটে। অবসান হয় আসেফ জাহর পূর্বপুরুষদের ২২৪ বছরের শাসন।

হায়দরাবাদ পরিণত হয় ভারতের একটি অঙ্গ রাজ্যে, যেখানে এক সময়ে মুসলিম শাসন ছিল। ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের পর হায়দরাবাদের স্বাধীনতা শেষ হয়ে যায় এবং তার শাসক নিজাম বাধ্য হয় ভারতের অধীনে চলে আসতে। এরপরই হায়দরাবাদ ভারতের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এর পেছনে ছিল সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত, রাজনৈতিক চাপ এবং গণহত্যার ভয়ঙ্কর পরিণতি।

১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদ দখল এবং গণহত্যা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কখনোই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বরং এটি হিংসা, বিভেদ এবং গণহত্যার দিকে নিয়ে যায়। হায়দরাবাদে সংঘটিত এই সহিংসতা ভারতের রাজনৈতিক ভূবৃত্তে এক দীর্ঘস্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে। আজও আমরা এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি, যাতে ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক হিংসার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে না পারে। [তথ্যসূত্র: মীর লায়েক আলীর লেখা দ্য ট্র্যাজেটি অব হায়দরাবাদ, ইউকিপিডিয়া, দ্য মিডল ইস্ট জার্নাল-খণ্ড:৪]

Shahadat Hossen Nihan
Nihan

Shahadat Hossen is a Journalist, Web Designer, SEO Expert, Entrepreneur & Founder at Tech Express & Pearl IT Limited. He made significant contributions in the fields of journalism, web design, SEO expertise, and entrepreneurship.

Would you like to share your thoughts?

Your email address will not be published. Required fields are marked *