
শাহাদৎ হোসেন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও আলোচনায় ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ যুগপৎ আন্দোলন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালুসহ পাঁচ দফা দাবিতে বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থী দল ‘যুগপৎ আন্দোলন’এর পথে হাঁটছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভোটকে এক বাক্সে একত্রিত করে সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এই ঐক্য নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এই ঐক্যের ধরন, এর আদর্শিক ভিত্তি এবং ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে।
যুগপৎ আন্দোলন কী: ‘যুগপৎ’ বা একযোগে আন্দোলনের ধারণাটি রাজনৈতিক ময়দানে নতুন নয়। যখন একাধিক দল অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলন পরিচালনা করে, তখন তাকে যুগপৎ আন্দোলন বলা হয়। ইসলামী দলগুলো, যেমন- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিসসহ বেশকিছু ইসলামী দল পিআর পদ্ধতির দাবিতে পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাদের লক্ষ্য এক; সম্মিলিত চাপের মাধ্যমে দাবি আদায়। তাদের যুক্তি, বর্তমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নির্বাচনী ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সঠিক প্রতিফলন ঘটে না, যার ফলে বিপুল সংখ্যক ইসলামপন্থী ভোটারের রায় সংসদে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি দল নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেলেও তা আসন সংখ্যায় রূপান্তরিত হতে ব্যর্থ হয়। এই বাস্তবতা থেকেই পিআর পদ্ধতির দাবি তাদের জন্য এক রাজনৈতিক ‘লাইফলাইন’। এই পদ্ধতির অধীনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন মিললে সংসদে তাদের সম্মিলিত শক্তি বহুগুণ বাড়বে। অতএব এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি আদর্শিক চেতনার চেয়েও বেশি করে নির্বাচনী সুবিধাবাদ -এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
এই রাজনৈতিক কৌশলটি আপাতদৃষ্টিতে বিচক্ষণ ও প্রশংসার যোগ্য। বিভেদ ভুলে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে একত্রিত হওয়া প্রশংসনীয়। কিন্তু যখন এই দলগুলো ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে, তখন তাদের ঐক্যকে কেবল রাজনৈতিক কৌশলের চশমায় দেখলে চলবে না, বরং ইসলামের ঐক্যের মূলনীতির আলোকে এর বিচার করা অপরিহার্য।
ইসলামে ঐক্যের ধারণাটি কোনো রাজনৈতিক কৌশল নয়। বরং এটি ঈমানের শর্ত। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে “সিসাঢালা প্রাচীর” (সূরা আস-সাফ, আয়াত: ৪) এর সাথে তুলনা করেছেন এবং “আল্লাহর রজ্জু সম্মিলিতভাবে ধারণ করার” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৩) নির্দেশ দিয়েছেন। রসুলাল্লাহ (সা.)-এর ভাষায়, মুমিনরা “এক দেহের ন্যায়”।
ইসলামে ঐক্যের দর্শন: ইসলামে ঐক্য কোনো রাজনৈতিক শ্লোগান নয় বরং এটি ঈমানের একটি মৌলিক ভিত্তি। এই ঐক্য কোনো শর্ত বা স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল নয়; এর ভিত্তি হলো তাওহীদ তথা এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তার প্রতি নিঃশর্ত বিশ্বাস এবং তাঁর রসুলের (সা.) প্রতি আনুগত্য। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই ঐক্যের গুরুত্ব বারংবার তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৩)।
এই আয়াতে ‘আল্লাহর রজ্জু’ বা দড়ি বলতে কুরআন ও ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। যা উম্মাহর ঐক্যের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক স্বার্থ, ভিন্ন নেতা বা ভিন্ন দলের পতাকা এই ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না।
রসুলাল্লাহ (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করে বলেছেন: “পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে তুমি মুমিনদেরকে একটি দেহের মতো দেখবে। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন পুরো শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। ইসলাম যে ঐক্যের কথা বলে, তা হলো একটি ‘সিসাঢালা প্রাচীর’ এর মতো ঐক্য (সূরা আস-সাফ, আয়াত: ৪), যেখানে আদর্শ, লক্ষ্য এবং নেতৃত্বে কোনো বিভেদ থাকতে পারে না।
অমীমাংসিত প্রশ্নাবলী: ইসলামের এই মৌলিক আদর্শের সামনে যখন আমরা বর্তমান রাজনৈতিক ঐক্যকে রাখি, তখন কিছু গুরুতর প্রশ্ন সামনে চলে আসে-
এক উম্মাহ, একাধিক নেতা কেন? ইসলামী দলগুলোর প্রত্যেকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে। যদি লক্ষ্য সত্যিই এক হয়, তাহলে তাদের নেতা ভিন্ন কেন? ইসলামের ইতিহাসে মুসলিমরা একজন খলিফা বা আমিরের অধীনে ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা যদি সত্যিই প্রকৃত ইসলামের আদর্শে বিশ্বাসী হয়, তবে তাকওয়া ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন নেতাকে মেনে নিয়ে তার অধীনে কাজ করতে পারছে না কেন? একাধিক নেতার অধীনে এই আন্দোলন কি নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিভাজনকে স্বীকার করে নেওয়া নয়, যা কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী নয় কি?
আদর্শগত দ্বন্দ্বের বাস্তবতা: অতীতে আমরা দেখেছি, জামায়াতে ইসলামীর সাথে ইসলামী আন্দোলনের আদর্শিক বিরোধ, খেলাফত মজলিসের সাথে অন্য দলগুলোর কর্মপন্থাগত মতবিরোধ। আকীদা, রাজনৈতিক দর্শন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে যে গভীর দূরত্ব বিদ্যমান তা সর্বজনবিদিত। এই যুগপৎ আন্দোলন কি সেই মৌলিক বিরোধগুলো সমাধানে ফলপ্রসূ হবে? নাকি শুধুমাত্র নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য আদর্শিক প্রশ্নগুলোকে কার্পেটের নিচে চাপা দেওয়া হয়েছে? যদি ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই আদর্শিক দ্বন্দ্বগুলো পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন জাতিকে তারা কোন ইসলামের দিকে নিয়ে যাবে?
ক্ষমতার রূপরেখা: ধরে নেওয়া যাক, তাদের আন্দোলন সফল হলো এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলল। তখন রাষ্ট্র কোন দলের আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হবে? অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষানীতি বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন দলের ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে? এটি কি একটি আদর্শিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে না? যে দলগুলো সামান্য বিষয়েও একে অপরকে ভ্রান্ত আখ্যা দিতে দ্বিধা করে না, তারা কীভাবে একটি ইসলামি রাষ্ট্রের মতো জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় পরিচালনা করবে?
ঐক্যের আন্তরিকতা: কুরআনে কারীমে আল্লাহ বলেন: “তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৫)। ইসলামে দলাদলি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রশ্ন হলো, এই আন্দোলন কি শতধাবিভক্ত ইসলামী দলগুলোকে বিলুপ্ত করে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার আন্তরিক প্রচেষ্টা, নাকি নিজ নিজ দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে শুধুমাত্র ভোটের বাক্স ভারী করার একটি কৌশল? যদি উদ্দেশ্য কেবল সংসদে কয়েকটি আসন লাভ করা হয়, তবে তা কি দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
প্রয়োজন কৌশলগত নয়, আদর্শিক ঐক্য: ইসলামী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন হয়তো একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আমাদের বুঝতে হবে যে, এটি একটি কৌশলগত সমঝোতা, আদর্শিক ঐক্য নয়। যে ঐক্য শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দাবি বা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তা প্রায়শই স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ভেঙে পড়ে।
প্রতীক বনাম বাস্তবতা: এই ঐক্যের চূড়ান্ত স্ববিরোধিতাটি নিহিত রয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যেই। যুগপৎ আন্দোলন হলেও, নির্বাচনের সময় ভোট কি একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে পড়বে, নাকি প্রতিটি দল নিজ নিজ প্রতীকে ভোট চাইবে? যদি তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করে, তাহলে এই ঐক্যের কার্যকারিতা কোথায়? ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে একই আসনে একাধিক ইসলামপন্থী প্রার্থী দাঁড়ালে ভোট বিভক্ত হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী, যা আদতে তাদের প্রতিপক্ষকেই সুবিধা করে দেবে। আর যদি পিআর পদ্ধতি চালুও হয়, তবুও ভিন্ন ভিন্ন দলের প্রতীকে ভোট দেওয়ার অর্থ হলো বিভেদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। তাহলে যে ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার কথা বলা হচ্ছে, তা তো কেবল একটি কথার কথা। যে আন্দোলন ভোটের মাঠে বিভেদকে জিইয়ে রাখে, সে আন্দোলন ঐক্যের নামে একটি প্রহসন ছাড়া আর কী?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামী জোট গঠনের ইতিহাস ব্যর্থতার ইতিহাসেই ভরা। অতীতে গঠিত হওয়া ঐক্যজোট বা বিভিন্ন সময়ের প্ল্যাটফর্মগুলো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে বিলীন হয়ে গেছে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার স্বাদ পেলেও তারা ইসলাম বা মুসলিম উম্মাহর জন্য কোনো অর্থবহ ও টেকসই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। বরং তাদের বিভক্তি মুসলিম সমাজে হতাশা ও বিভেদকেই আরও গভীর করেছে।
প্রকৃত ইসলামী ঐক্য হলো সেটিই যা গড়ে ওঠে কুরআন ও সুন্নাহর নিঃশর্ত অনুসরণের ভিত্তিতে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে এক নেতার অধীনে, এক পতাকাতলে একত্রিত হওয়া। যে দিন ইসলামী দলগুলো তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম, পতাকা ও নেতৃত্ব বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র ‘ইসলাম’ এর পরিচয়ে আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে এক হতে পারবে, সেদিনই তাদের ঐক্য হবে সত্যিকারের শক্তিশালী এবং তারা আল্লাহ তা’আলার সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন।
লেখক: সাংবাদিক